ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং - | NCTB BOOK

ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারী পর্যন্ত সবাইকে লক্ষ্য অর্জনে ৰাধা দেয়। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত এবং প্রাপ্ত ফলাফলের মধ্যে সাধারণত গরমিল বা বিচ্যুতি থাকে। আর এ বিচ্যুতি থেকেই ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই ঝুঁকি ভূমিকা রাখে। ফলে ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিত করা এবং ঝুঁকির পরিমাপ করার প্রয়োজন হয়। এ অধ্যায়ে আমরা ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তার বিভিন্ন দিক জানতে পারব

এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-

  • ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার উৎস চিহ্নিত করতে পারব।
  • আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারব।
  • ঝুঁকিমুক্ত আয় ও ঝুঁকিবহুল আগ্নের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারব।
  • আদর্শ বিচ্যুতি ও ভেলার ব্যবহার করে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিরা ব্যাখ্যা করতে পারব।
Content updated By

# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন

নিচের উদ্দীপকটি পড়ে প্রশ্নের উত্তর দাও

জনাব কালাম একটি কোম্পানিতে সাধারণ শেয়ারের বিনিয়োগকারী। তার ১,০০০ টাকা মূল্যের ১০টি শেয়ার রয়েছে। কিন্তু সে কোম্পানি তাকে প্রতিবছর লভ্যাংশ প্রদান করত না।

ভবিষ্যতের বিনিয়োগের ওপর
কোম্পানির ইচ্ছার ওপর
ভবিষ্যতে অর্জিত মুনাফার ওপর
ম্যানেজারের ওপর

ভূমিকা

রোহান নবম শ্রেণির ছাত্র। সে তার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ প্রত্যাশা করে। রাশেদ সাহেব একজন কৃষক। তিনি এ বছর জমি থেকে ভালো ফলন প্রত্যাশা করেন। সুমনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শেষ বর্ষের ছাত্রী। সে তার বিবিএ ডিগ্রি শেষ করে একটি ভালো চাকরি আশা করে। এখানে রোহানের জিপিএ ৫ পাওয়া, রাশেদ সাহেবের জমি থেকে ভালো ফলন এবং সুমনার ভালো চাকরি পাওয়া প্রতিটি বিষয় অনিশ্চিত। কারণ প্রতিটি বিষয় ভবিষ্যতের সাথে জড়িত। রোহান জিপিএ ৫ পেতে পারে, নাও পেতে পারে, রাশেদ সাহেবের জমিতে এ বছর ভালো ফলন হতে পারে, নাও পারে এবং সুমনা ভালো চাকরি পেতে পারে; নাও পেতে পারে । এভাবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অনিশ্চয়তা বিদ্যমান থাকে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ন্যায় ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম অনিশ্চয়তা পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ ভবিষ্যতে কোম্পানির পণ্যের আশানুরূপ বিক্রি হবে কি না, প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জন করতে পারবে কি না, প্রত্যাশিত মূল্যে কাঁচামাল ক্রয় করতে পারবে কি না-এরূপ অসংখ্য অনিশ্চয়তা থাকে। অনুরূপভাবে একজন বিনিয়োগকারী কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করে প্রত্যাশিত লভ্যাংশ পাবে কি না, একটি কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে বিনিয়োগ থেকে প্রত্যাশিত নগদ প্রবাহ পাবে কি না এসব অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয় ।

এসব অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রকৃত ফলাফল প্রত্যাশিত ফলাফলের চেয়ে কম বা বেশি হয়। প্রকৃত ফলাফল প্রত্যাশিত ফলাফল থেকে ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাকেই ব্যবসা অর্থায়নে ঝুঁকি বলা হয়। যেমন: কোম্পানি আশা করছে, আগামী বছর ২০% নিট মুনাফা লাভ করবে, কিন্তু প্রকৃত লাভ হলো ১৫% । এখানে, এই ৫% বিচ্যুতি ঝুঁকির উৎস। নিম্নে আরো কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা হলো:

মনে কর, একটি কোম্পানি আগামী তিন বছর যথাক্রমে ৫০ লক্ষ টাকা, ৬৫ লক্ষ টাকা এবং ৭৫ লক্ষ টাকার পণ্য বিক্রি হবে বলে প্রত্যাশা করে। কিন্তু তিন বছর শেষে দেখা গেল উল্লেখিত বছরগুলোতে কোম্পানির পণ্য বিক্রি হয় যথাক্রমে ৪৫ লক্ষ টাকা, ৬৬ লক্ষ টাকা এবং ৭১ লক্ষ টাকা। আবার একজন বিনিয়োগকারী বছরে প্রতি শেয়ারে ১৫ টাকা লভ্যাংশ প্রত্যাশা করে একটি কোম্পানির শেয়ার কেনে। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল, কোম্পানি প্রতি শেয়ারে মাত্র ১০ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করে। বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সিদ্ধান্তের প্রত্যাশার থেকে প্রাপ্তির একটি ব্যবধান থাকে এবং এ ব্যবধান হওয়ার সম্ভাবনা থেকে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্য কোনো বিনিয়োগকারীর প্রত্যাশিত আয় থেকে প্রকৃত আয় বেশি হলেও ঝুঁকির সৃষ্টি হতে পারে। যেমন: উক্ত বিনিয়োগকারী প্রতি শেয়ারে যখন ১৫ টাকা লভ্যাংশ প্রত্যাশা করে বছর শেষে ২০ টাকা লভ্যাংশ পায়, তখনো এই ৫ টাকা বিচ্যুতি ঝুঁকির উৎস বলে বিবেচিত। কারণ ওই অবস্থায় প্রকৃত আয় কেন প্রত্যাশিত আয় থেকে বেশি হলো সেই কারণ বিনিয়োগকারীর কাছে অজানা, এই কারণে সেটাও ঝুঁকি।

ঝুঁকির আরেকটি উদাহরণ এই রকম। দুটি বিনিয়োগের প্রথমটি থেকে আমরা গত তিন বছর ১০% হারে মুনাফা পেয়েছি। দ্বিতীয় বিনিয়োগ থেকে আমরা গত তিন বছর ৫%, ১০% ও ১৫% মুনাফা পেয়েছি। এখানে দুটি বিনিয়োগ প্রতিটির অর্জিত মুনাফার গড় সমান বা ১০% কিন্তু প্রথম বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত ও দ্বিতীয় বিনিয়োগ ঝুঁকিযুক্ত। কারণ ঝুঁকির আরেকটি ধারণা হলো আয়ের উত্থান-পতন। বেশি উত্থান-পতন হলে বেশি ঝুঁকি এবং উত্থান-পতন না হলে ঝুঁকি নেই ।

ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পার্থক্য

যদিও অনিশ্চয়তা থেকে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়, ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, সব অনিশ্চয়তা ঝুঁকি নয়। পূর্বেই বলা হয়েছে, খারাপ কোনো ঘটনা ঘটার আশঙ্কাই হচ্ছে ঝুঁকি। কিন্তু খারাপ কোনো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কেমন তা যদি জানা না থাকে, তবে সেই অনিশ্চয়তাকে ঝুঁকি বলা যায় না। অন্যভাবে বলা যায়, অনিশ্চয়তার যে অংশটুকু পরিমাপ করা যায় সে অংশকে ঝুঁকি বলা হয়। কিছু কিছু অনিশ্চয়তা আছে, যা পরিমাপ করা যায়না। উদাহরণস্বরূপ, একটি কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তার মৃত্যু হতে পারে, এটা একটা অনিশ্চয়তা, কিন্তু এই অনিশ্চয়তাকে পরিমাপ করা যায় না। ফলে এই রকম অনিশ্চয়তাকে ঝুঁকি বলা যায় না। দ্বিতীয়ত, ঝুঁকি পরিমাপ করা যায় বলে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে ঝুঁকির পরিমাণ কমানো যায়। কিন্তু অনিশ্চয়তাকে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে কমানো বা পরিহার করা যায় না । উদাহরণস্বরূপ, ভূমিকম্পের কারণে কোনো কোম্পানির অফিস দালান ভেঙে যেতে পারে, কিন্তু ভূমিকম্প কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে নেই বলে এই অনিশ্চয়তাকে কোম্পানি পরিহার করতে পারে না। পক্ষান্তরে, আগামী বছর কোম্পানির বিক্রয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা একটি ঝুঁকি। কারণ, এই ঝুঁকি পরিমাপ করা যায় এবং এই ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য কোম্পানি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে পারে। যেমন: অগ্রিম বিক্রি করতে পারে।

ঝুঁকির উৎস

ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সিদ্ধান্তের সাথে কিছু না কিছু ঝুঁকি জড়িত থাকে। এসব ঝুঁকির কারণে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ফলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে এসব ঝুঁকি যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হয়। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য এসব ঝুঁকির উৎস ও শ্রেণি খুঁজে বের করা জরুরি। এ ব্যাপারে কারবারের প্রেক্ষাপট আর বিনিয়োগকারীর প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নিচে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঝুঁকির উৎস আলোচনা করা হলো।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিকোণ থেকে

ক) ব্যবসায়িক ঝুঁকি : ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সফলভাবে চালানোর জন্য বিভিন্ন রকম পরিচালনা ব্যয়ের সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ, কাঁচামাল ক্রয়, শ্রমিকদের বেতন, অফিস ভাড়া, বিমা খরচ ইত্যাদি। এসব পরিচালনা খরচ পরিশোধের অক্ষমতা থেকে ব্যবসায়িক ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। কোনো কোম্পানির পরিচালনা ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা নির্ভর করে বিক্রয় থেকে আয়ের স্থিতিশীলতা এবং পরিচালনা খরচের মিশ্রণ অর্থাৎ 

স্থায়ী এবং চলতি খরচের অনুপাতের উপর। বিক্রয় আয়ে স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থাৎ বিক্রয়লব্ধ কোনো সময় আয় বেশি আবার কোনো সময় কম হলে, প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ব্যয় মেটাতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় । আবার পরিচালন ব্যয়ে স্থায়ী খরচ যেমন: অফিস ভাড়া, বিমা খরচ ইত্যাদির পরিমাণ বেশি হলে ব্যবসায়িক ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। যদি কোম্পানিটি সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে অর্থাৎ কোম্পানি কোনো বহিস্থ অর্থায়ন না করে তখন মুনাফাসংক্রান্ত এই অনিশ্চয়তাকে ব্যবসায়িক ঝুঁকি বলে। এর উৎস হিসেবে বিক্রয়মূল্য পরিবর্তন, বিক্রয় পরিমাণ পরিবর্তন, উৎপাদনের উপকরণের মূল্য পরিবর্তন, অতিরিক্ত স্থায়ী খরচের প্রবণতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

খ) আর্থিক ঝুঁকি : এই ধরনের ঝুঁকি বহিস্থ উৎস থেকে অর্থায়ন থেকে সৃষ্টি হয়। যে প্রতিষ্ঠানের ঋণের মাধ্যমে সংগৃহীত তহবিল বেশি, সেই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ঝুঁকি বেশি। কারণ ঋণ মূলধনের জন্য সুদ প্রদান করা বাধ্যতামূলক। পক্ষান্তরে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করা হলে মুনাফা বণ্টন বাধ্যতামূলক নয়। সুতরাং ঋণ মূলধন ব্যবহার করা হলে কারবারটি যদি লাভজনক না হয়, তখন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান আইনের আশ্রয় নিতে পারে এবং ফলে কারবারটির বিলোপসাধন হতে পারে। ঋণ মূলধন ব্যবহার করলে সুদ এবং উক্ত অর্থ পরিশোধের দায় সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো কোম্পানি যদি ১৫% হারে ৫০ লক্ষ টাকার ৫ বছর মেয়াদি বন্ড বিক্রয় করে, তাহলে প্রতিবছর ৭,৫০,০০০ টাকা সুদ এবং পাঁচ বছর শেষে ৫০ লক্ষ টাকা পরিশোধের দায় সৃষ্টি হয়। কোম্পানি সাধারণত ঋণকৃত মূলধন বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত নগদ প্রবাহ দিয়ে ঋণকৃত মূলধনের দায় পরিশোধ করে। কোনো কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকে পর্যাপ্ত নগদ প্রবাহ না পেলে দায় পরিশোধের অক্ষমতা দেখা দিতে পারে। দীর্ঘদিন দায় পরিশোধ করতে না পারলে ঋণ সরবরাহকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে এবং কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে ফলে এরূপ দায় পরিশোধের অক্ষমতা থেকে যে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়, তাকে আর্থিক ঝুঁকি বলা হয়।

বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে

ক) সুদ হারের ঝুঁকি : যেসব বিনিয়োগকারী বন্ড, ডিবেঞ্চার ইত্যাদি ক্রয় করে, তাদেরকে সুদ হারের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয়। কারণ বাজারে সুদের হারের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের বিনিয়োগের মূল্য উঠা-নামা করে। সুদের হার বাড়লে এসব বিনিয়োগের অর্থাৎ বন্ড, ডিবেঞ্চারের বাজারমূল্য কমে, আবার সুদের হার কমলে এসব বিনিয়োগের বাজারমূল্য বাড়ে। সুদের হারের পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগের মূল্য হ্রাসের আশঙ্কাকেই সুদ হারের ঝুঁকি বলা হয়।

খ) তারল্য ঝুঁকি : বিনিয়োগকারীর অর্থ শেয়ার,বন্ড বা ডিবেঞ্চার ইত্যাদিতে বিনিয়োগের পর যেকোনো সময় এসব বিনিয়োগ নগদায়নের প্রয়োজন হয়। আশা করা হয়, বিনিয়োগকারী এসব বিনিয়োগ যুক্তিসংগত মূল্যে বিক্রয় করে নগদায়ন করতে পারবে। কিন্তু কোনো কারণে যদি বিনিয়োগকারী সহজে এবং যুক্তিসংগত মূল্যে বিক্রয় করতে না পারে, তখন তারল্য ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। তারল্য ঝুঁকি সাধারণত যে বাজারে এসব বিনিয়োগ যথা: শেয়ার, বন্ড, ডিবেঞ্চার ইত্যাদি কেনাবেচা হয়, সে বাজারের আকার এবং কাঠামোর উপর নির্ভর করে। একমালিকানা ও অংশীদারি কারবারে তারল্য ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ নগদ অর্থের প্রয়োজন হলে কারবারটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ সহজে ও যুক্তিসংগত মূল্যে বিক্রয় করা যায় না। পক্ষান্তরে, একজন বিনিয়োগকারী কোনো কোম্পানির শেয়ার কিনলে, তাকে তারল্য ঝুঁকি নিয়ে তেমন চিন্তা করতে হয় না। কারণ সে ইচ্ছে করলে যেকোনো সময় সেকেন্ডারি মূলধন বাজার বা শেয়ার মার্কেট গিয়ে তার শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারে। মূলধনি বাজারে কোন বিনিয়োগকারী যদি কোম্পানির বন্ড বা ডিবেঞ্চার ক্রয় করে, ব্যাংকিং কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে নিয়োজিত থাকে সেক্ষেত্রে তারল্য ঝুঁকি নিয়ে চিন্তা করতে হয়। কারণ আমাদের সেকেন্ডারি মূলধনি বাজারে যত সহজে শেয়ারের ক্রেতা পাওয়া যায়, তত সহজে বন্ড-ডিবেঞ্চারের ক্রেতা পাওয়া যায় না। তাই সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকে নগদায়ন করা সময়সাধ্য ও ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে।

Content updated By

ঝুঁকির তাৎপর্য

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঝুঁকির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, যা ঝুঁকির তাৎপর্য বহন করে।

প্রথমত : যেকোনো কোম্পানির সাফল্য তথা সার্বিক উদ্দেশ্য সাধনে ঝুঁকির প্রভাব রয়েছে। পূর্বেই বলা হয়েছে প্রত্যাশার বাইরে কোনো কিছু ঘটার সম্ভাবনাকেই ঝুঁকি বলা হয়। ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা প্রণয়নের সময়েই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঘটনাসমূহ বিচার-বিশ্লেষণ করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অপ্রত্যাশিত ক্ষতি থেকে বাঁচা যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি কোম্পানি শুধু নদীপথে কাঁচামাল আনয়নের সুবিধার কথা চিন্তা করে নদীর ধারে কারখানা স্থাপনা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দু-এক বছর পরে জলোচ্ছ্বাসে, নদীভাঙনের ফলে কারখানাটি নদীতে বিলীন হয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানকে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। ফলে কোম্পানিটির সাফল্য অর্জন সম্ভব হবে না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি যদি এই সম্ভাবনার কথা আগে থেকেই বিবেচনা করত, তবে হয়তো ঠিক নদীর পাড়েই কারখানা স্থাপন করত না এবং তাতে করে একটি সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হতো।

দ্বিতীয়ত : ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্জন নির্ভর করে পণ্যের বাজার চাহিদার উপর। ফলে ব্যবসায় শুরু করার আগেই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বাজার চাহিদা সম্পর্কিত বিচার-বিশ্লেষণ করে বাস্তবসম্মত চাহিদার অনুমান করে সেই অনুযায়ী ব্যবসায় পরিচালনা ও বাস্তবায়ন করতে হয়। বাজারের প্রকৃত চাহিদা অনুমেয় চাহিদা থেকে কম বা বেশি হতে পারে। কোনো কারণে প্রকৃত বিক্রয় অনুমেয় বিক্রয় থেকে খুব কম হলে পর্যাপ্ত মুনাফা অর্জন সম্ভব হয় না। উদাহরণস্বরূপ বর্ষাকালে অতি বৃষ্টিপাত আশা করে ছাতা প্রস্তুতকারী একটি কোম্পানি অধিক ছাতা প্রস্তুত করে; কিন্তু পরবর্তীতে যদি বর্ষাকালে কম বৃষ্টিপাত হয়, ছাতা প্রস্তুতকারীর ছাতা অবিক্রীত থাকার সম্ভাবনা থাকে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে প্রয়োজনীয় মুনাফা অর্জন সম্ভব হবে না। এই অবস্থায় ছাতার সাথে যদি অন্য কিছু পণ্যও কোম্পানি তৈরি করত, তবে হয়তো বৃষ্টি কম হলেও সেই পণ্যের চাহিদা হ্রাস পেত না এবং কারবারটি কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জন করতে পারত।

Content updated By

ঝুঁকিমুক্ত আয় ও ঝুঁকিবহুল আয়

সকল আয় ঝুঁকিবহুল নয়, কিছু আয় আছে যা ঝুঁকিমুক্ত আয় হিসেবে গণ্য হয়। অর্থাৎ এ রকম আয়ে, প্রকৃত আয় সব সময় প্রত্যাশিত আয়ের সমান হয়। কোনো ব্যাংকে যদি তুমি মেয়াদি আমানত রাখ, তবে এর প্রত্যাশিত আয় ও বাস্তব আয়ের মধ্যে তেমন পার্থক্য হয় না। এটা ঝুঁকিমুক্ত আয়ের একটি ধরন। কোনো দেশের সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ড থেকে প্রাপ্ত আয় ঝুঁকিমুক্ত আয় হিসেবে গণ্য হয়। সরকার কর্তৃক ইস্যু হয় বলে এসব বিনিয়োগকে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হয়। এসব ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত আয় নির্দিষ্ট থাকে বলে অর্থাৎ নির্দিষ্ট হারে আয় দেয়া হয় বলে, প্রাপ্ত আয়কে ঝুঁকিমুক্ত আয় হিসেবে গণ্য করা যায়।

প্রত্যাশিত আয় থেকে প্রকৃত আয়ের মধ্যে ব্যবধান হবার সম্ভাবনা হচ্ছে ঝুঁকি। সাধারণ আয়ের একটা অংশ ঝুঁকিমুক্ত আর বাকিটা ঝুঁকিযুক্ত। যেসব আয়ের সাথে ঝুঁকি জড়িত সেসব আয়কে ঝুঁকিবহুল আয় বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন বিনিয়োগকারী কোনো কোম্পানির সাধারণ শেয়ার ক্রয় করলে ভবিষ্যতে লভ্যাংশ প্রাপ্তি তার প্রত্যাশিত লভ্যাংশের সমান হবে- এরকম কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। ভবিষ্যতে কোম্পানি কী পরিমাণ লভ্যাংশ দেবে সেটা নির্ভর করে ভবিষ্যৎ বছরগুলোতে অর্জিত মুনাফা এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর। অতএব, বিনিয়োগকারীর জন্য উক্ত শেয়ার থেকে আয় একটি ঝুঁকি বহল আয় হিসেবে পরিগণিত হবে। এমনকি আয় নির্দিষ্ট থাকে না বলে সাধারণ শেয়ার থেকে প্রাপ্ত আয় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিবহুল আয় হিসেবে গণ্য হয় ।

ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার পরিমাপ

ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সফলভাবে পরিচালনার জন্য ঝুঁকি পরিমাপ করা অত্যাবশ্যকীয়। প্রত্যাশিত আয় থেকে প্রকৃত আয়ের বিচ্যুতি থেকেই ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। প্রত্যাশিত আয় থেকে প্রকৃত আয়ের বিচ্যুতি যত বেশি হয়, ঝুঁকি তত বাড়ে, আয়ের বিচ্যুতি যত কম ঝুঁকি তত কমে। এ কারণে প্রত্যাশিত আয় এবং প্রকৃত আয়ের বিচ্যুতি বা  প্রত্যাশিত ফলাফল এবং প্রকৃত ফলাফলের বিচ্যুতি থেকে ঝুঁকি পরিমাপ করা হয়।

ঝুঁকি পরিমাপের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। প্রয়োজন বা অবস্থাভেদে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় । এই পর্যায়ে আমরা ঝুঁকি পরিমাপের জন্য আদর্শ বিচ্যুতির ব্যবহার দেখব।

আদর্শ বিচ্যুতি : আদর্শ বিচ্যুতি ব্যবহার করে অতীতে অর্জিত আয়ের বিচ্যুতি থেকে যেমন ঝুঁকি পরিমাপ করা হয়, তেমনি ভবিষ্যতে প্রত্যাশিত আয়ের ঝুঁকি ও পরিমাপ করা হয়। এটি একটি পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি। নিচে আদর্শ বিস্তৃতির সূত্র দেয়া হলো :

আদর্শ বিচ্যুতি =‌‌‌√((Σ(আয় হার - গড় হার)^২)/n -১)

এখানে, Σ(আয় হার-গড় হার)^২ = অতীতে অর্জিত আয় হার থেকে গড় আয় হারের পার্থক্যের বর্গের সমষ্টি

n= বছরের সংখ্যা

উদাহরণ : নিচের ছকে, একটি প্রকল্পের ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরের আয় দেয়া আছে। আমরা এর আয় ও ঝুঁকি গণনা করব।

বছর আয়(%) গড় থেকে ব্যবধান (আয়-গড়) ব্যবধানের বর্গ
২০০৭ ২০ (২০-১৩)=৭ (৭×৭)= ৪৯
২০০৮ (৫-১৩)=৮ (৮×৮)=৬৪
২০০৯ -৫ (-৫-১৩)= -১৮ (১৮×১৮)=
২০১০ ১৫ (১৫-১৩)=২ (২×২)=৪
২০১১ ৩০ (৩০-১৩)=১৭ (১৭×১৭)
যোগফল= ৬৫ ব্যবধানে বর্গের যোগফল= ৭৩০
গড় আয় ৬৫/৫=১৩% ব্যবধানের বর্গের গড়=৭৩০/(n-১)

১৮২.৫

আদর্শ বিচ্যুতি =√ ১৮২.৫

= ১৩.৫%

প্রথমে পাঁচ বছরের আয় যোগ করে ৫ দিয়ে ভাগ করলে আমরা গত পাঁচ বছরের গড় আয় পাব। টেবিলে এটা দেখা যাচ্ছে ১৩%। এবার ঝুঁকি গণনার জন্য আদর্শ বিচ্যুতি গণনা করতে হবে। প্রথমে আমরা প্রতিবছরের আয় থেকে গড় আয় বা ১৩%-এর ব্যবধান বের করব। এর পরের কলামে এটাকে বর্গ করতে হবে। এবার উক্ত বর্গসমূহের যোগফল বের হলো ৭৩০। একে (n-1) বা (৫-১) বা ৪ দিয়ে ভাগ করতে হবে। যত বছরের আয় তা থেকে সর্বদাই ১ কম দিয়ে ভাগ করতে হবে। ভাগফলকে বর্গমূল করলে আমরা আদর্শ বিচ্যুতি পাব। উদাহরণে এটা ১৩.৫%। সুতরাং ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত আয়ের ভিত্তিতে আমাদের গড় আয় ১৩% আর ঝুঁকির পরিমাণ ১৩.৫% । এই আয় ও ঝুঁকি ব্যবহার করে আমরা ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিতে পারব। যেমন: এর বিকল্প একটা প্রকল্পে যদি আমরা ১৩% আয় পাই এবং ১৫% আদর্শ বিচ্যুতি বা ঝুঁকি পাই, তবে সেটা থেকে আমাদের প্রথম প্রকল্প বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ একই আয়ে কম ঝুঁকি বেশি গ্রহণযোগ্য। আবার অন্য একটি বিকল্প প্রকল্পে যদি সমান ঝুঁকি হয় কিন্তু লাভের গড় কম হয়, তবে সেটা থেকেও আমাদের মূল প্রকল্প বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ সমান ঝুঁকিতে অধিক লাভ বেশি গ্রহণযোগ্য।

সিদ্ধান্ত গ্রহণ নীতি : সাধারণত আদর্শ বিচ্যুতির বড় মান অধিক ঝুঁকি এবং আদর্শ বিচ্যুতির ছোট মান কম ঝুঁকি নির্দেশ করে। সমান আয়ে কম ঝুঁকি বেশি গ্রহণযোগ্য এবং সমান ঝুঁকিতে অধিক লাভ বেশি গ্রহণযোগ্য ।

Content updated By

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

Please, contribute by adding content to বহুনির্বাচনি প্রশ্ন.
Content

সৃজনশীল প্রশ্ন

Please, contribute by adding content to সৃজনশীল প্রশ্ন.
Content
Promotion